উপন্যাস – চন্দ্রপ্রতাপগড়ের আতঙ্ক, লেখক – দীপিকা মজুমদার, প্রকাশক – বুক ফার্ম
বইটিতে মোট দুটি উপন্যাসিকা ও একটি উপন্যাস আছে, যথাক্রমে – মায়াবিনীর করোটি, নাগপাশ এবং চন্দ্রপ্রতাপগড়ের আতঙ্ক। ভৌতিক গল্প বলা হলেও এরমধ্যে কোনোটাই কিন্তু চিরাচরিত প্রথার ভৌতিক গল্প নয়। প্রতিটা গল্পের বেশিরভাগ জুড়েই রয়েছে দৈবিক ক্রিয়াকলাপ ও কালোজাদু। সব গল্পের জন্যেই লেখিকা কমবেশি গবেষণা করছেন, তার জন্য একাধারে যেমন গল্পগুলো সুন্দর হয়েছে, তেমনই কিছু জায়গায় তথ্যভার বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নীচে আলাদা ভাবে তিনটি গল্পের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলাম।
১) মায়াবিনীর করোটি – এক বাঙালী লেখক লন্ডনে একটি সাহিত্য সম্মেলনে গিয়ে মুখোমুখি হন এক ভয়ঙ্কর বিপদের। তার সখ্যতা হয় একটি কিউরিও শপের মালিকের সাথে, যার নিজেরই ব্যক্তিগত জীবন রহস্যতে ঘেরা। তার কাছ থেকেই একটি অ্যান্টিক জিনিস পায় লেখকরূপী গল্পের নায়ক। তার অসাবধানতার ফলেই জেগে ওঠে এক প্রাচীন কালো জাদু, সহস্র বছরের পুরোনো এক অভিশাপ। তারপর কিভাবে পরিত্রাণ পাওয়া যায় এই অভিশাপ থেকে, আদৌ পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব কিনা – সেই নিয়েই এই গল্প।বইতে সংকলিত দুটি উপন্যাসের মধ্যে এটি প্রথম। গল্প হিসেবে খুবই ভালো। বহু পুরোনো অভিশাপ বর্তমান কালে জীবিত হয়ে ওঠার আখ্যান ভালোই লিখেছেন লেখিকা। তবে গল্পের শেষে অভিশপ্ত মূর্তির ওভাবে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরেও ফিরে আসাটা – ঠিক মনে হল না। মনে হল যেন জোর করে লেখা হয়েছে সেটি।
২) নাগপাশ – একটি দুঃস্বপ্নের রাতের অভিজ্ঞতার পর একটি বাচ্চা ছেলেকে মেঘালয় থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সুদূর কলকাতায়। তারপর থেকে কোনদিনই সে ফিরে যেতে পারেনি তার নিজের বাড়িতে। তার মা ফিরিয়ে নেয়নি তাকে আর। কলকাতায় থেকেই বড় হতে থাকে সে। পড়াশোনা করতে থাকে হোস্টেলে থেকে। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে একদিন বাধ্য হয়েই ফিরে যেতে হয় তার নিজের বাড়ি, মেঘালয়ে। কেনই বা মা তার অতি প্রিয় ছেলেকে দূরে সরিয়ে দিলেন, কেনই বা বড় হয়ে সেই ছেলের ফিরে যেতে হল নিজের বাড়িতে – মায়ের অসম্মতি থাকা সত্ত্বেও, কী ভয়ানক ব্যাপার চলছে এসবের পিছনে – এসব নিয়েই এই গল্প। বইতে সংকলিত দুটি উপন্যাসের মধ্যে এটি দ্বিতীয়। এবং বইতে আমার পছন্দের সবথেকে পছন্দের গল্প এটিই। গল্পের বুনন খুব সুন্দর। খুব সুন্দর ভাবে প্রতিটা চরিত্র, ঘটনা ও সময় সাজানো হয়েছে। তেমনই রয়েছে জোরালো টুইস্ট। পুরো গল্প শেষ করার পর পাঠককে আবার প্রথম থেকে ভাবতে বাধ্য করে।
৩) চন্দ্রপ্রতাপগড়ের আতঙ্ক – দক্ষিণের একটা বিশাল দুর্গকে ভেঙে সেখানে বানানো হবে একটা হোটেল। আগে বহুবার এই চেষ্টা করেও হাতে এসেছে শুধুই অসফলতা। আগে যারা এই কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন তাদের মধ্যে কয়েকজনের মস্তিষ্ক বিকৃতি দেখা দিয়েছে। রটে যায় দুর্গটি নাকি অভিশপ্ত। তাই এবার অনেক কোমর বেঁধে কাজে নামা হয়। কলকাতার একজন স্ট্রাগলিং ইঞ্জিনিয়ারকে পাঠানো হয় দায়িত্ব দিয়ে। তারপর কী হল সেই নিয়েই উপন্যাস। আছে পূর্ব জন্মের স্মৃতি। আছে সংক্ষিপ্ত ঐতিহাসিক সংযোগ, আলাউদ্দিন খিলজির দাক্ষিণাত্য আক্রমণের কথা, এক চোল রাজার পারিবারিক বৃত্তান্ত। আছে রাক্ষস বংশের নৃশংসতার গল্প। গোটা গল্পটাকে সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে। প্রথম ও শেষের দিকে ভরপুর উত্তেজনা, মাঝের কিছুটা অংশে যেন বাঁধন খানিকটা আলগা হয়ে যায়। বেশ কিছু তথ্যে সমৃদ্ধ করা হয়েছে বিশেষ কিছু জায়গা। উপন্যাসটি একটি ভালো দক্ষিণী সিনেমার প্লট হতে পারে। তবে গল্পের কিছু কিছু জায়গা আমার ব্যক্তিগতভাবে খুব একটা ভালো লাগল না; যেমন – গল্পে কাকতালীয়তা আমার বড্ড বেশি মনে হয়েছে; ‘বোধি’ নামক একটি চরিত্র – গল্পে যার বিশেষ কোনো ভূমিকাই ছিল না, শুধুমাত্র গল্পের শেষে একটা সাসপেন্স অথবা পরের পর্বের একটা খোঁচা দেবার জন্যেই ওই চরিত্রকে রাখা হয়েছে বলে আমার মনে হল। তাছাড়া নায়িকা যখন জানেই গন্তব্যে তার প্রেমিক আগে থেকেই বর্তমান, তখন আরেকজনকে মিথ্যা প্রেমিক সাজিয়ে নিয়ে যাবার ব্যাপারটা হজম করতে একটু অসুবিধা হল; তাছাড়া পুরো উপন্যাস জুড়ে এত বড় একটা কর্মকাণ্ড ঘটল, সেখানে প্রতিকূলতা আরেকটু বেশী হলে অথবা ভিলেন আরেকটু শক্তিশালী হলে গল্প আরেকটু মজাদার হত বলে আমার মনে হয়।
বইয়ের অলঙ্করণ করেছেন লেখিকা নিজেই। লেখিকার আগেও উনি একজন শিল্পী। ওঁর দুর্দান্ত কিছু অলঙ্করণের কাজ আমি আগেও দেখেছি। তবে এই বইয়ের আঁকাগুলো লেখিকার দ্বারা সৃষ্ট সেরা আঁকা নয়। হয়ত নিজের লেখা বলে শিল্পী আঁকার প্রতি অতটা মনোনিবেশ করেননি। 😀 যাইহোক, অলঙ্করণ আরেকটু ভালো হতে পারত।